বাঁশখালীতে কেন বারবার লাশ পড়ে

অনলাইন ডেস্ক •

ফের লাশ পড়ল বাঁশখালীর কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রে। ২০১৬ সালের এপ্রিলে এই বিদ্যুৎকেন্দ্রেইে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছিলেন ছয়জন। ২০২১ সালে এসে সেই এপ্রিলেই আবার রক্ত ঝরল বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে। আগেরবার জমি অধিগ্রহণ নিয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকদের সঙ্গে বিরোধ ছিল স্থানীয় বাসিন্দাদের।

পাঁচ বছর আগে গুলিবিদ্ধ হয়ে যারা নিহত হয়েছেন তারা ছিলেন গ্রামবাসী। এবার যারা প্রাণ হারিয়েছেন তারা বিদ্যুৎকেন্দ্রেরই শ্রমিক। কিন্তু রমজানের মতো স্পর্শকাতর সময়ে এবার শ্রমিকদের ওপর কেন গুলি চালাল পুলিশ- এ প্রশ্নটি সামনে আসছে বারবার। শ্রমিকরা বলছেন, কোনো কারণ ছাড়াই নির্বিচারে গুলি করেছে পুলিশ। অন্যদিকে পুলিশ বলছে, বাইরের ইন্ধনে বেপরোয়া ছিল শ্রমিকরা। বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভেতরে থাকা গাড়িতেও আগুন দিয়েছে তারা। বাধ্য হয়েই গুলি করেছে পুলিশ।

সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন চট্টগ্রাম জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী বলেছেন, ‘শুক্রবার থেকেই উত্তেজনা বিরাজ করছিল বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে। রমজানে ১০ ঘণ্টার স্থলে আট ঘণ্টা কাজ করতে চেয়েছিল শ্রমিকরা। বেতন-ভাতা বাড়ানোর আরও কিছু আনুষঙ্গিক দাবি ছিল তাদের। দেশের প্রায় প্রতিটি শিল্প কারখানায় শ্রমিকদের এমন দাবি করতে দেখা যায়। কিন্তু অন্য কোনো স্থানে এভাবে গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনা ঘটে না। বিদ্যুৎকেন্দ্রে বারবার এমন ঘটনার নেপথ্যে অন্য কোনো কারণ আছে কিনা সেটি খতিয়ে দেখা দরকার। বিচক্ষণতার সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলা করা গেলে লাশ ফেলার ঘটনা এড়ানো যেত। চীনা কর্তৃপক্ষ বিচক্ষণতার সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলা করলে প্রাণ হারানোর ঘটনা এড়ানো যেত বলে মনে করেন গণ্ডামার ইউনিয়নের স্থানীয় বাসিন্দারাও। চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মমিনুর রহমানও মনে করছেন ছোট ঘটনায় বড় ধরনের মূল্য দিতে হয়েছে বাঁশখালীতে। তিনি বলেন, ‘গুলি ছোড়ার মতো পরিস্থিতি কেন তৈরি হলো, এটির নেপথ্যে অন্য কোনো শক্তি আছে কিনা তা খতিয়ে দেখতে তদন্ত কমিটি গঠন করেছি আমরা।’

গাড়িতে আগুন দিল কারা:কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রে কাজ করছেন প্রায় সাত হাজার শ্রমিক। ২৭ জন উপ-ঠিকাদারের মাধ্যমে শ্রমিকদের পরিচালনা করছে যৌথ মালিকানায় থাকা চীনা কর্তৃপক্ষ। অনেক দিন ধরে শ্রমিকদের মধ্যে ক্ষোভ থাকলেও বেতন-ভাতা ও কর্মঘণ্টার ইস্যু নিয়ে তারা বড় ধরনের শোডাউন করেন শুক্রবার। পুলিশ ফাঁকা গুলি ছুড়ে সেদিন তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। গতকাল আবার একত্রিত হন শ্রমিকরা। চীনা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সরাসরি দেখা করতে মরিয়া হয়ে ওঠেন তারা। প্রতিনিধি ঠিক করে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দেখা করতে বলা হয় শ্রমিকদের। কিন্তু তারা পুলিশের এ কথায় কর্ণপাত করেননি। এর মধ্যে হঠাৎ দেখা যায় আগুনের লেলিহান শিখা। বিদ্যুৎকেন্দ্রে থাকা গাড়িতে কে বা কারা আগুন দেয়। পুলিশ বলছে, শ্রমিকদের একটি অংশ বাইরের ইন্ধনে গাড়িতে আগুন দিয়েছে। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে এমন দাবি করেছেন পুলিশের ডিআইজি আনোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, পুলিশ বাধ্য হয়ে গুলি ছুড়েছে।

গুলিবিদ্ধ শ্রমিকরা যা বললেন:বাঁ পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন মো. মিজান। প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে তার। যে কারণে বিকেলে অস্ত্রোপচার করতে হয়েছে তার পায়ে। চমেক হাসপাতালের ২৬ নম্বর অর্থোপেডিক বিভাগের অস্ত্রোপচার কক্ষের সামনে কান্নাভেজা কণ্ঠে মিজান সমকালকে বলেন, ‘বিদ্যুৎকেন্দ্রে কাজ করতে দুই মাস আগে নোয়াখালী থেকে বাঁশখালীতে আসি। শুক্রবার থেকে বেতন নিয়ে ঝামেলা হওয়ায় কাজ বন্ধ ছিল। শনিবার সকালে শ্রমিকদের একটি পক্ষ থেকে জানানো হয়, বেতন নিয়ে জটিলতা থাকায় কর্তৃপক্ষ কথা বলবে আমাদের সঙ্গে। কথা বলতে নিজেদের রুম থেকে সকাল সাড়ে ৯টার দিকে অফিসে যাওয়ার সময় হঠাৎ শুনি গুলির শব্দ। কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেখি আমার পা থেকে রক্ত ঝরছে। পরে অজ্ঞান হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ি।’

মিজানের মতো ডান হাতে গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালের বিছানায় যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন মো. মোরশেদ। বিদ্যুৎকেন্দ্রে তিনি রডমিস্ত্রির কাজ করতেন। মোরশেদ সমকালকে বলেন, ‘শুক্রবার জুমার নামাজের পর বেতন নিয়ে সমস্যার সুরাহা করার কথা থাকলেও তা হয়নি। কোম্পানির পক্ষ থেকে আমাদের পাঁচ থেকে ১০ জনকে কথা বলতে যেতে বলে। শনিবার ভোর সাড়ে ৬টার দিকে আমাদের পক্ষ থেকে পাঁচজন কথা বলতে যান। তার কিছুক্ষণ পর তারা হ্যান্ডমাইকে ঘোষণা দিয়ে আমাদের জানায়, আমাদের কোনো দাবি মেনে নেওয়া হবে না। এমন কথা শুনে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে সবাই। পরে শ্রমিকরা রুম থেকে বের হলে কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমাদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া হয়।’

গুলিবিদ্ধ হয়ে চিকিৎসাধীন শ্রমিক মো. আজাদ জানান, কোনো কারণ ছাড়াই হঠাৎ গুলি ছুড়তে থাকে পুলিশ। তারা বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করছিলেন। এর মধ্যে হঠাৎ করে গুলির শব্দ শুনতে পান তারা। পাশে থাকা কয়েকজন শ্রমিককে মাটিতে লুটিয়ে পড়তে দেখেন।

রমজানে একটু বাড়তি সুবিধা চাওয়ার অপরাধে নির্বিচারে গুলি করে শ্রমিক মারা হয়েছে বলে দাবি করেন বেলাল হোসেন নামে আহত আরেক শ্রমিক। তিনি বলেন, গুলি করার মতো কোনো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। শ্রমিকদের বিক্ষোভ দেখে চীনা কর্মকর্তারা ভয়ে পুলিশকে গুলি করতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। সাধারণ শ্রমিকদের জীবনের দিকে না তাকিয়ে পুলিশ চীনা কর্মকর্তাদের ফাঁদে পা দিয়েছে।